তৃণমূল নেতাকর্মীদের অবহেলা ও একনায়কতন্ত্রের দম্ভে জনগণকে প্রতিপক্ষ বানানোই ছিল শেষ ধাক্কা

প্রকাশিত: ৩:১৩ অপরাহ্ণ, জুলাই ১১, ২০২৫

তৃণমূল নেতাকর্মীদের অবহেলা ও একনায়কতন্ত্রের দম্ভে জনগণকে প্রতিপক্ষ বানানোই ছিল শেষ ধাক্কা

রাশেদ রাসু :
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় পরিবর্তনের সাক্ষী হলো ২০২৪ সালের আগস্ট। টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দেশ ত্যাগ করলেন। ছাত্র ও নাগরিক সমাজের বৃহত্তর জাগরণ, একনায়কতান্ত্রিক দমন-পীড়ন, প্রশাসনিক দুর্নীতি এবং আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা—সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
১. স্বৈরতন্ত্র ও গণবিরোধী নীতি: একটি ধ্বংসাত্মক ধারা
২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের ভয়াবহ অনিয়ম এবং বিরোধী দল দমন করে ‘নকল গণতন্ত্র’ কায়েম রাখার অভিযোগ অনেক দিনের। ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ও সরকার বিরোধী কণ্ঠরোধে বেপরোয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় ক্যাডার দিয়ে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলিবর্ষণ, গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের মাধ্যমে সরকার গণতন্ত্রের শেষ ভরসাটুকু ধ্বংস করে দেয়।
২. সাংগঠনিক দুর্বলতা ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের অবহেলা
দলের ভেতর থেকে উঠে আসা ছাত্রনেতা, ইউনিয়ন পর্যায়ের সংগঠক ও কমিউনিটি কর্মীদেরকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে। ফলে দলে একটি সাংগঠনিক শূন্যতা তৈরি হয়। অনেক নেতা ভয় ও রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় দল ছাড়েন বা আত্মগোপনে চলে যান। এতে সংগঠন কাঠামোগতভাবে ভেঙে পড়ে।
৩. দুর্নীতি ও অর্থ পাচার: ‘ক্ষমতার ব্যাধি’
পাসপোর্ট অফিস, গাড়ি নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স—প্রায় সব ক্ষেত্রেই ঘুষ ছিল নিয়মানুগ। সরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়। দলের সিনিয়র নেতাদের পরিবার ও আত্মীয়রা সরাসরি এসব কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এতে সরকার সম্পর্কে মানুষের আস্থা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৪. জনসংযোগ বিচ্ছিন্নতা ও নেতৃত্বের অন্ধকার
প্রশিক্ষণবিহীন রাজনৈতিক ক্যাডার ও পরামর্শহীন প্রশাসন সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকারকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে, সরকারের শীর্ষ পর্যায় ছাড়া কেউ বাস্তব নীতিনির্ধারণে অংশ নিতে পারেনি। এতে ‘জনতার সরকার’ একচ্ছত্র স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হয়।
পতনের মূল কারণ: বিশ্লেষণসারণি
বিষয় বিস্তারিত”
অবৈধ ক্ষমতার পদক্ষেপ নির্বাচন জালিয়াতি, বিরোধী দল ও সংবাদমাধ্যম দমন, ছাত্রআন্দোলনে গুলি, দলের ভিত্তির দুর্বলতা তৃণমূল অবহেলা, নেতৃত্বহীনতা, রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা,
অর্থনৈতিক দুর্নীতি, ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি, ঘুষ-ভিত্তিক নিয়োগ ও লেনদেন,
নেতৃত্বের বিচ্ছিন্নতা একক নেতৃত্ব, উপদেষ্টা-নির্ভর সিদ্ধান্ত, জনগণ থেকে দূরত্ব।
গণআন্দোলনের বিস্ফোরণ: মৃত্যু ও বিদ্রোহ
৩৬ দিনের ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের গুলি ও সংঘর্ষে প্রাণ হারান অন্তত ১,৩০০–১,৪০০ জন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কারফিউ, সেনা মোতায়েন ও ইন্টারনেট বন্ধসহ নানা চেষ্টা করা হলেও কিছুই কাজে আসেনি। আন্দোলনকারীরা ‘একদফা—সরকার পতন’ দাবিতে অটল থাকেন।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও কূটনৈতিক বিপর্যয়
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক পশ্চিমা শক্তি শেখ হাসিনার সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্বাচনবিধির অনিয়মের সমালোচনা করেছিল। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে চীন সফরেও কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পাননি তিনি। ফলে বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিকভাবে ভারতের ওপর অতিনির্ভর হয়ে পড়ে, যা অভ্যন্তরীণ সমালোচনার কারণ হয়।
পদত্যাগ ও দেশত্যাগ: এক শাসনের পরিসমাপ্তি
সোমবার দুপুরে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন শেখ হাসিনা। এরপর সামরিক হেলিকপ্টারে দেশত্যাগ করেন। তার ছোট বোন শেখ রেহানা সঙ্গে ছিলেন। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটিও আর সম্ভব হয়নি।
দলীয় ভবিষ্যৎ ও জনগণের প্রত্যাশা
শেখ হাসিনার পদত্যাগের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। অনেকেই বলছেন, শেখ হাসিনার শেষ সময়ের অহংকারী সিদ্ধান্ত, জনবিচ্ছিন্নতা ও গোষ্ঠীগত ক্ষমতার দম্ভই দলের অস্তিত্বকেই হুমকিতে ফেলেছে।
✊ পরিশেষে : ‘জনগণ চাই নতুন নেতৃত্ব, গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রত্যাবর্তন’—এটাই আজকের বাংলাদেশ।