লোহার খাঁচায় জীবন: সন্তানদের জন্য সংগ্রামী এক মায়ের করুণ বাস্তবতা

প্রকাশিত: ৯:১৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ৮, ২০২৫

লোহার খাঁচায় জীবন: সন্তানদের জন্য সংগ্রামী এক মায়ের করুণ বাস্তবতা

প্রতিবেদন রাশেদ রাসু:

ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের রাস্তায় লোহার খাঁচার মতো ঠেলাগাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক মা—সঙ্গে রয়েছে তার ১৩ মাস বয়সী তিন জমজ সন্তান। পাশে হাঁটছে তার বড় মেয়ে, বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর। এমন হৃদয়বিদারক দৃশ্য এলাকাবাসীকে কাঁদিয়েছে, বিস্মিত করেছে সামাজিক বাস্তবতা।

এই সংগ্রামী মায়ের নাম জান্নাত বেগম। ময়মনসিংহ জেলার মেয়ে জান্নাত ভালোবেসে বিয়ে করেন ঢাকার হাবিল নামের এক যুবককে। বিয়ের পর ঠাকুরগাঁওয়ে বসবাস শুরু করেন তারা। একে একে চার সন্তানের জন্ম দেন—প্রথমে একটি কন্যা সন্তান, পরে একসাথে জন্ম নেয় তিন জমজ শিশু (দুই মেয়ে ও এক ছেলে)। কিন্তু সুখ বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সন্তান জন্মের কিছুদিন পরেই স্বামী হাবিল পরিবার ছেড়ে চলে যান।

চরম বাস্তবতায় পড়ে যান জান্নাত। চার শিশু সন্তানকে নিয়ে শুরু হয় তার একা জীবনযুদ্ধ। বাইরে কাজ করতে গেলেই শিশুদের ফেলে রাখার চিন্তায় সে সুযোগটাও হারিয়ে ফেলেন। শেষ পর্যন্ত সন্তানদের ক্ষুধা মেটাতে খুঁজে নেন এক ব্যতিক্রমী উপায়—চাকা লাগানো লোহার খাঁচার মতো ঠেলাগাড়ি বানিয়ে সেখানে বসিয়ে তিন জমজ সন্তানকে নিয়ে রাস্তায় বের হন সাহায্য তুলতে। পাশে ছোট্ট মেয়েটি হাঁটে। এভাবেই চলছে তার জীবন।

জান্নাত বেগম বলেন, “আমি সাহায্য তুলে দিন পার করি—এটা নিশ্চয়ই লজ্জার। কিন্তু সন্তানদের ক্ষুধার্ত মুখ আমি দেখতে পারি না। কেউ কেউ তো আমার সন্তানদের কিনে নেওয়ার প্রস্তাবও দিয়েছে। লাখ লাখ টাকা দিয়েছে। কিন্তু আমি মা, সন্তানের ভালোবাসার কাছে টাকা কিছুই না।”

তিনি জানান, সীমিত আয়ের কারণে শিশুদের ঠিকমতো খাওয়াতে পারেন না। পুষ্টিকর খাবার তো দূরের কথা, অনেক সময় পেট ভরে খাওয়ার ব্যবস্থাও হয় না।

প্রতিবেশী রোকসানা পারভীন বলেন, “একজন নারীর জন্য এত ছোট ছোট চারটি সন্তানকে একা লালনপালন করাই দুঃসাধ্য। তার পরেও জান্নাত রাস্তায় নেমে সংগ্রাম করে সন্তানদের মানুষ করার চেষ্টা করছেন। তিনি সত্যিই সাহসী এক মা।”

আরেক প্রতিবেশী শারমিন বলেন, “ওদের কান্না শুনলেই মনটা কেঁদে উঠে। সমাজের বিত্তবানরা সাহায্য করলে হয়তো এই পরিবারটির ভাগ্য বদলাতে পারত।”

এই করুণ খবর জানার পর ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. খায়রুল ইসলাম জানান, বিষয়টি তার অজানা ছিল। তবে খোঁজ পেয়ে জান্নাত বেগমের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে শুকনো খাবার পাঠানো হয়েছে।

তিনি বলেন, “তিনি যদি ভাড়া বাসায় থাকেন, তাহলে চাইলে তাকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া যদি তিনি সম্মানজনক কোনো পেশায় আসতে চান, তাহলে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। তার পাশে থাকার চেষ্টা করা হবে।”

জান্নাত বেগম ও তার শিশুদের জীবনযুদ্ধ আমাদের সমাজের অসংখ্য উপেক্ষিত বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। এই মায়ের জন্য রাষ্ট্র ও সমাজের সহানুভূতিশীল হাত বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।