বাংলাদেশে এক কিডনি বিক্রির গ্রাম ‘তারা আমার কিডনি নিয়েছে, আর আমাকে ফেলে গেছে’

প্রকাশিত: ৫:০১ অপরাহ্ণ, জুলাই ৪, ২০২৫

বাংলাদেশে এক কিডনি বিক্রির গ্রাম ‘তারা আমার কিডনি নিয়েছে, আর আমাকে ফেলে গেছে’

 

অনলাইন ডেস্ক :

অর্থনৈতিক সংকট, ঋণের বোঝা, কিংবা জুয়ার আসক্তি—বিভিন্ন কারণে অনেকেই পা ফেলছেন একটি ভয়ংকর ও অনৈতিক পথে—নিজের কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তবে এই সিদ্ধান্ত জীবনে স্বস্তির বদলে আরও দুর্ভোগ ডেকে আনছে।

বাইগুনি গ্রামের সফিরুদ্দিনের গল্প এমনই এক করুণ উদাহরণ। তিনি জানান, ভারতে অস্ত্রোপচারের পর কোনো রকম চিকিৎসা বা পর্যবেক্ষণ ছাড়াই তাকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পাসপোর্ট, প্রেসক্রিপশনসহ সব কাগজপত্র দালালরা রেখে দেয়, এমনকি প্রয়োজনীয় ওষুধও পাননি তিনি।

এই পাচার চক্রের শিকার অনেকেই জানেন না যে, তাদের কিডনি মূলত বিক্রি হয় ভারতের বিত্তশালী কিডনি রোগীদের কাছে। ২০২৩ সালে ভারতে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে মাত্র ১৩,৬০০টি, অথচ চূড়ান্ত পর্যায়ে কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ। এই বিশাল চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধান দালালচক্রকে আরও সক্রিয় করে তুলছে।

ব্র্যাকের অভিবাসন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান জানান, “কিছু মানুষ জানাশোনা সত্ত্বেও কিডনি বিক্রি করেন, তবে অনেকেই প্রতারিত হন।”

মোহাম্মদ সাজল (ছদ্মনাম) নামে এক ভুক্তভোগী জানান, ২০২২ সালে দিল্লির এক হাসপাতালে ১০ লাখ টাকার চুক্তিতে কিডনি বিক্রি করলেও তিনি পান মাত্র সাড়ে তিন লাখ। পরে হতাশ হয়ে সেই চক্রেই জড়িয়ে পড়েন। তবে দালালদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে অবশেষে সরে আসেন এবং এখন রাইড শেয়ারিং চালিয়ে জীবন চালাচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পাচার রোধে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের কার্যকর ব্যবস্থা নেই। ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনসুলার বিভাগের মহাপরিচালক শাহ মুহাম্মদ তানভির মনসুর জানান, অনেক হাসপাতালই দালালদের দেওয়া জাল কাগজের ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার করে দায় এড়িয়ে যায়।

ড. মনিরুজ্জামান বলেন, “বেশ কিছু ভারতীয় হাসপাতাল জানতেও জাল কাগজ গ্রহণ করে, কারণ অধিক প্রতিস্থাপন মানেই অধিক আয়।” ২০২৪ সালে ভারতে ড. বিজয়া রাজাকুমারি নামে এক চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়, যিনি অন্তত ১৫ বাংলাদেশির কিডনি প্রতিস্থাপনে জড়িত ছিলেন।

তবে দালালদের দাবি, একটি প্রতিস্থাপনে খরচ পড়ে ২৫-৩৫ লাখ টাকা, কিন্তু কিডনি বিক্রেতার হাতে আসে মাত্র ৩-৫ লাখ। বাকি অর্থ ভাগ হয় দালাল, ভুয়া কাগজ তৈরির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা ও হাসপাতালের অসাধু ব্যক্তিদের মধ্যে।

ভারতের কিডনি ওয়ারিয়র্স ফাউন্ডেশনের প্রধান বাসুন্ধরা রঘুবংশ বলেন, “চাহিদা থাকায় এই চোরাবাজার বন্ধ হচ্ছে না। তাই চাই সুসংগঠিত ও মানবিক ব্যবস্থাপনা, যেখানে বিক্রেতারা স্বাস্থ্যসেবা ও আর্থিক নিরাপত্তা পাবেন।”

এদিকে, বাইগুনির সফিরুদ্দিন আজও অর্ধনির্মিত ঘরের বারান্দায় বসে ভাবেন, তার স্বপ্নের ঘর কখন পূর্ণ হবে। তিনি তিক্ত কণ্ঠে বলেন, “তারা আমার কিডনি নিয়েছে, আর আমাকে ফেলে চলে গেছে।”